ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় উত্থানের গল্পের নাম চেঙ্গিস খান। সমাজের একেবারে তলানিতে কোনোমতে বেঁচে থাকা একটি পরিবারে জন্ম নিয়েও ইতিহাসের অন্যতম বিশ্ব বিজয়ী হয়ে ওঠার এমন নজির আর খুঁজে পাওয়া যায় না। চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
চেঙ্গিস খানের জীবনের শুরুর দিকের গল্প আমরা জানতে পারি বিখ্যাত পাণ্ডুলিপি ইউয়ান চাও বি শি (Yuan Chao Bi Shi) থেকে, যা The Secret History of the Yuan Dynasty অথবা The Secret History of the Mongols নামে অনূদিত হয়। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ইউয়ান সাম্রাজ্যের গোপন ইতিহাস’ কিংবা ‘মোঙ্গলদের গোপন ইতিহাস’। সম্ভবত চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর প্রায় এক দশক পরে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে এই পাণ্ডুলিপিটি শেষ হয়। The Secret History বা ‘গোপন ইতিহাস’-এর বেশিরভাগেই এসেছে চেঙ্গিস খানের ছেলেবেলা, তার বিভিন্ন অভিযান এবং বিশ্ব বিজয়ের নেপথ্যের গল্প। উল্লেখিত পাণ্ডুলিপিতে বর্ণিত ঘটনাবলির উপর ভিত্তি করেই এই লেখার গল্পগুলো বলা বা লেখা হয়েছে। চেঙ্গিস খানের ছেলেবেলার ইতিহাসের উল্লেখ পাওয়া যায় পারস্যের ইতিহাসবিদ রশিদ আদ-দ্বীনের The History of the Tribes নামক আরেকটি গ্রন্থে। এ দুটি গ্রন্থের কিছু বিষয়ে পারস্পরিক মতপার্থক্য থাকলেও, ঘটনা প্রবাহের যে বর্ণনা তাতে এ দুটি সূত্রের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চেঙ্গিস খানের জীবনের এসব ঘটনা ঐতিহাসিক সূত্রের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যায় না। দুটি গ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাবলির সময়কাল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে এটা ধরেই নেওয়া যায় যে, চেঙ্গিস খানের মতো এমন একটি চরিত্রের উত্থানের গল্পে ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রণ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
Table of Contents
‘তেমুজিন’ :চেঙ্গিস খানের ছেলেবেলা
১২ শতকের মঙ্গোলীয় প্রান্তর ছিল যুদ্ধপ্রবণ বিশৃঙ্খল এক জনপদ। সে সময়ে মঙ্গোলীয়রা অনেকগুলো ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত ছিল এবং নিজেদের ভিতরকার সম্পর্ক একদমই ভালো ছিল না। মঙ্গোলীয়, তারতার ও নাইমানের মতো প্রতিবেশী যাযাবর গোষ্ঠীগুলো একটা মিথ্যা আর বিশ্বাসঘাতকতাময় আন্তঃগোত্র সম্পর্কের মধ্যে বাস করত।
তেমুজিন অর্থাত্ ভবিষ্যত্ চেঙ্গিস খান ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইয়েসুগাই ছিলেন কিয়াদ উপগোত্রের প্রধান এবং কয়েকটি ছোট ছোট গোত্র নিয়ে তৈরি ছোট একটি জোটের নেতা। নয় বছর বয়সে তার বাবা তেমুজিনকে ওখুনুগাদ গোত্র পরিদর্শনে নিয়ে যান। সে সময় ওখুনুগাদ নেতা, যে কিনা ‘দেই দ্য ওয়াইজ’ (Dei the wise) নামে পরিচিত ছিলেন, তার মেয়ে বোরতার সাথে পরিচয় ঘটে ইয়েসুগাইয়ের। তিনি লক্ষ করেন যে তেমুজিন ও বোরতার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটি পারস্পরিক ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। ইয়েসুগাই তাদের দুজনের বিয়ের প্রস্তাব করেন, যা ‘দেই’ (Dei) সানন্দে মেনে নেন। সে অঞ্চলের রেওয়াজ অনুসারে তেমুজিনকে তার ভবিষ্যত্ স্ত্রীর পরিবারের সাথে কিছু সময় থেকে যেতে হয়।
তেমুজিনকে সেখানে রেখে তার বাবা ইয়েসুগাই মনে খুশি ও গর্ব নিয়ে তার ক্যাম্পে ফিরে আসেন। কিন্তু ফেরার পথেই দুর্ভাগ্যের শিকার হন তিনি। পথে একদল লোকের সাথে একটা ভোজে অংশ নেন ইয়েসুগাই। কিন্তু সেই লোকগুলো যে মঙ্গোলীয়দের চিরশত্রু তারতার গোত্রের সেটা তিনি জানতেন না। এই ভোজের এক ফাঁকেই ওসব তারতাররা গোপনে ইয়েসুগাইয়ের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেন। ভোজ শেষে কিছু না বুঝেই ইয়েসুগাই রওনা দেন নিজের ক্যাম্পের উদ্দেশে। কিন্তু ক্যাম্পে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। নেতৃত্বশূন্য জোটের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য তেমুজিনকে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু জোটভুক্ত অন্যান্য গোত্র তেমুজিনের বয়সের কারণে তার উপর আস্থা রাখতে পারে না। জোটের অন্য গোত্রের নেতারা সবাই তেমুজিনের ক্যাম্প ত্যাগ করে। এমনকি তেমুজিনকে নিজের কিয়াদ গোষ্ঠীর লোকেরাও ত্যাগ করে। সবশেষে তেমুজিনের ক্যাম্পে তার মা, চার ভাইবোন, দুই সত্ ভাই ও এক পারিবারিক ভৃত্য ছাড়া আর কাউকেই পাওয়া যায় না।
এরপরে তেমুজিন ও তার বিশৃঙ্খল হয়ে পড়া গোষ্ঠীর জন্য জীবন ধারণ হয়ে পড়ে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। ঘাস-লতা-পাতা-শিকড় খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকা যাকে বলে। একদিন তেমুজিন ও তার ভাই কাসার একটি মাছ শিকার করেন। কিন্তু তার সত্ ভাইয়েরা ওই মাছটি কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেন। জীবন ধারণ যখন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, একটি মাছ তখন জীবন ও অনাহারে মৃত্যুর নির্ধারক। সত্ ভাইদের এমন স্বার্থপর আচরণে তেমুজিন ভীষণ ক্ষিপ্ত হন। তীর-ধনুক এনে তিনি তার এক সত্ ভাই বেকতারকে মেরে ফেলেন। তেমুজিন যে একদিন চেঙ্গিস খানের মতো এক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন এত অল্প বয়সে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা থেকে সে ধারণা কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। যদিও আমরা ধরে নিই যে, চেঙ্গিস খান তার শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনের অতিরিক্তই প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন, কিন্তু ছোট তেমুজিন তার অনুসারীদের প্রতি যথেষ্ট দয়াশীলও ছিলেন। তেমুজিন তার অন্য সত্ ভাইকে ক্ষমা করে দেন, এবং এক পর্যায়ে তার দুজনে ভালো বন্ধু হয়ে যান।

এসব কষ্ট, সত্ ভাইকে খুন করার মতো ছোট-বড় সব ঘটনাকে সাথে নিয়ে তেমুজিন ও তার পরিবারের জীবন এগিয়ে চলেন। এসবের পাশাপাশি তেমুজিনকে বেশকিছু অ্যাডভেঞ্চারের মুখোমুখিও হতে হয়। যেমন তাইচিগাড গোষ্ঠী কর্তৃক আটক হওয়া, ঘোড়া চোর ধরা ইত্যাদি। কিন্তু এসবের কোনো ঘটনাই তেমুজিনকে এতটুকুও দুর্বল করতে পারেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে তিনি আরও শক্তিশালী হয়েছেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি আবার দেইয়ের ক্যাম্পে ফিরে যান তার স্ত্রী বোরতাকে নিয়ে আসার জন্য। নিঃসন্দেহে তেমুজিন একজন মানুষ হিসেবে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তির বিচারে তার ভাণ্ডার একেবারেই শূন্য। তার ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা মাত্র পাঁচ, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। যদিও খুব দ্রুতই এ অবস্থার পরিবর্তন আসন্ন।
মঙ্গোলিয়া প্রান্তরে যুদ্ধ-বিগ্রহ
একদিন মারকিদ গোষ্ঠী তেমুজিনের ক্যাম্প আক্রমণ করে। তেমুজিন ও তার পরিবার পালিয়ে একটা জঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারলেও, তার স্ত্রী বোরতা ধরা পড়ে যান। তেমুজিন কোনোভাবেই সরাসরি প্রতিরোধ করার মতো অবস্থায় ছিলেন না, কেননা মারকিদরা ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী। পলায়ণপর তেমুজিনের মাথায় নতুন ভাবনা আসে। তার জানা মতে তার বাবার এক রক্ত শপথের ভাই (anda) আছে, কিয়েরিড গোত্রের তঘরুল খান। তেমুজিন সাহায্যের আশায় তঘরুল খানের কাছে যান। আন্ডা বা রক্ত শপথের ভাই ইয়েসুগাইকে নিয়ে তঘরুলের স্মৃতি তখনো উজ্জ্বল। তঘরুল তেমুজিনকে সাহায্য করতে রাজি হয়ে যান। তিনি ১৫০০ জনের একটি সৈন্যদল তৈরি করেন। সেইসাথে আরও ১৫০০ জন সৈন্যসহ তার মিত্র জমুঘাকেও সাথে নিয়ে কিশোর তেমুজিনকে সাহায্য করতে প্রস্তুত হন। এর পাশাপাশি তেমুজিনের বাবার নেতৃত্বে যারা যুদ্ধ করেছেন, নিজ গোষ্ঠীর সেসব লোককে তেমুজিন খবর পাঠান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। তারাও সর্বমোট ৫০০ লোক প্রস্তুত হয়ে পড়েন তেমুজিনের সাথে যুদ্ধে যেতে। যদিও তেমুজিনের নেতৃত্বের সৈন্যদলটি সবচেয়ে ছোট ছিল, তবুও এই সৈন্যদলটিই তার জীবনের প্রথম সৈন্যদল, যার নেতৃত্ব তিনি দেন। মারকিদদের বিরুদ্ধে তিনজন যার যার সৈন্যদল নিয়ে যুদ্ধে যাত্রা করেন। শত্রুদের ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে এই যুদ্ধে তেমুজিন জয় লাভ করেন এবং স্ত্রী বোরতাকে উদ্ধার করেন।
মিত্রতা ও বন্ধুতার মাধ্যমে তেমুজিন প্রথমবারের মতো সামরিক শক্তি অর্জন করতে সমর্থ হন। কাকতালীয়ভাবে তেমুজিনের অন্যতম মিত্র জমুঘাও ছিলেন একজন মঙ্গোলীয় এবং তেমুজিনের শৈশবের আন্ডা বা রক্ত শপথের ভাই। জমুঘা ও তেমুজিন আবারও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং বেশ কয়েকটি মঙ্গোলীয় গোত্রের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। চারদিকে সবাই তাদেরকে একটি ভীতিকর শক্তি হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে, হয়তো নিপতিত মঙ্গোলীয় রাজত্ব পুনরুজ্জীবিত হওয়ার এটাই সময়।
একদিন তেমুজিন ও জমুঘা তাদের গোত্রের লোকজন নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন সাধারণ একদল যাযাবরের মতো। জমুঘা তেমুজিনকে থেমে তাঁবু স্থাপনের পরামর্শ দেন। কিন্তু তেমুজিন তার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারেন না। তিনি তার মাকে জিজ্ঞেস করেন জমুঘা কী বলতে চাইছেন। জমুঘার এ পরামর্শ তিনি আমলে না নিয়েই সামনের দিকে এগোতে থাকেন যদিও জমুঘা ইতিমধ্যে থেমে গেছেন। দুই নেতার এমন দুদিকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে সাথে থাকা মঙ্গোলীয়রা কী করবে বুঝতে পারে না। কিন্তু খুব দ্রুতই তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে তাদেরকে যেকোনো একজন নেতা বেছে নিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই একদল জমুঘার সাথে এবং অন্যরা তেমুজিনের সাথে গিয়ে যোগদান করে। যেসব মঙ্গোলীয় তেমুজিনের সাথে যোগ দান করে তারা আজীবন আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা করে এবং এর প্রতিদান হিসেবে তেমুজিনও তাদেরকে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে নেতৃত্ব দেওয়ার শপথ করেন। অল্প কিছুদিন পরেই, একটি বিশাল সমাবেশে অনুসারীরা তেমুজিনকে ‘খান’ উপাধিতে ভূষিত করে। এখন এক নতুন শত্রুকে মোকাবিলা করতে হবে যে কিছুদিন আগেও তার বন্ধু ছিল। তেমুজিন একক নেতৃত্বের আসনে বসলেন এই প্রথম। তঘরুল ও জমুঘার সাথে তার পুরোনো মিত্রতা তাকে ক্ষমতার কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং সত্যিকার অর্থে সেই ক্ষমতাকে তেমুজিন আঁকড়ে ধরতে পেরেছেন শক্ত হাতে।

‘খান’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার ঠিক পরেই জমুঘার কিছু লোক তেমুজিনের গোত্রের কিছু লোকের ঘোড়া চুরি করে। এই সামান্য ঘটনাই এই দুই নেতার মধ্যে যুদ্ধের সূত্রপাত করে। যুদ্ধ শুরু হয় এবং তেমুজিন পরাজিত হন। এরপরের দশ বছরের মতো সময়কালে কী ঘটেছিল তা The Secret History-তে উল্লেখ করা নেই। রশিদ আদ-দ্বীনের মতে, অনুসারীরা তেমুজিনকে ত্যাগ করে এবং তেমুজিন পরবর্তীকালে শত্রুদের দ্বারা আটক হন। সম্ভবত তাকে চীনে দেশান্তরিত করা হয়েছিল। কয়েক বছর পর তিনি আবারও মঙ্গোলীয় প্রান্তরে ফিরে আসেন, জমুঘাকে পরাজিত করেন এবং আবারও ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সমর্থ হন। তেমুজিনের প্রত্যাবর্তনের সময়ে তঘরুল খানও তার নিজের গোত্রের মানুষের কাছেই সিংহাসন হারান এবং কারা-খিতাই রাজ্যে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হন। তেমুজিনের মতো তিনিও তার রাজত্ব পুনরুদ্ধার করেন, এবং সেটা সম্ভবত তেমুজিনের সাহায্যেই।
The Secret History-তে এসব ঘটনার বর্ণনা নেই। বরং সরাসরি প্রায় এক দশক পরে ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে তারতারদের বিরুদ্ধে তেমুজিন ও তঘরুলের বিজয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে জমুঘা মারকিদ, নাইমান ও ওইরাডদের সাথে শক্তিশালী জোট গড়ে তোলেন। তেমুজিন যেমন পরবর্তীতে চেঙ্গিস খানে পরিণত হন, তেমনি জমুঘার নাম হয়ে যায় গুর খান।
জমুঘা ও চেঙ্গিসের দ্বন্দ্ব আবারও বাড়তে শুরু করে। অবশেষে সকল মিত্র বাহিনীসহ জমুঘা চেঙ্গিস খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। কোইটানে এই দুই যোদ্ধার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ হবে। এই হুমকিতে তেমুজিন আবার তঘরুল খাকে জোটবদ্ধ হতে প্রস্তাব করেন। জমুঘা পুরোনো মিত্র হলেও তঘরুল রাজি হন তেমুজিনের প্রস্তাবে। মঙ্গোলীয় প্রান্তরে এসব জোট বা মৈত্রী কখনোই স্থিতিশীল বা দীর্ঘস্থায়ী হতো না। দুই সৈন্যদল কোইটানে মুখোমুখি হয়। এবার এসপার নইলে ওসপার। কিন্তু আবহাওয়া হঠাত্ বৈরী হয়ে পড়ে। শুরু হয় তুষার ঝড়। তুষারে আটকে পড়ে দুই পক্ষই যুদ্ধ বাতিল করে চলে যায়। সেনা প্রত্যাহারের এই সময়ে ভাগ্য কিছুটা তেমুজিনের পক্ষে চলে যায়। পুরোনো শত্রু ও জমুঘার বর্তমান মিত্র গোষ্ঠী তাইচিগাডদের আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করে দেয় তেমুজিন।

তেমুজিন ও জমুঘার ভিতরে দীর্ঘদিন যাবত বিরাজমান বিবাদের মীমাংসা বা সমঝোতা করে দু’দল আবার শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু তেমুজিন আর অপেক্ষা করেননি। ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়া তারতারদের তিনি আক্রমণ করেন। ১২০২ সালে তার দীর্ঘদিনের শত্রু, যারা তার বাবাকে হত্যা করে মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিল, সেই তারতারদের তিনি পরাজিত করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেন। তারতারদের বিরুদ্ধে তেমুজিনের এই বিজয় কাহিনি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে তঘরুল খান বয়সের কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। তঘরুলের ছেলে, যিনি তেমুজিনকে অপছন্দ করতেন, নানাভাবে তঘরুলকে বোঝান যে এখন আর তেমুজিনের মিত্র হয়ে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তঘরুল এক সমাবেশে তেমুজিনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে তেমুজিনের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
তেমুজিন আরও পশ্চিম দিকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পশ্চিমে এগিয়ে যেতে যেতে দিগন্তে এক বিশাল সেনাদল দেখা যায় তাদের দিকে এগিয়ে আসতে। এই সেনাদলের নের্তৃত্বে তঘরুল ও জমুঘা। তেমুজিন বাধ্য হন লড়াই করতে। তার সেনাদল শত্রুর সেনাদলের তুলনায় খুবই ছোট ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে রাত পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হন। রাতে খালকা নদীর দিকে পালিয়ে যান। তেমুজিনের সেনাদল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পালানোর আগে। কিন্তু নদীর পাড়ে বেশ কয়েকটি বন্ধু গোত্রের সাথে দেখা হয়ে যায় তার, যারা তেমুজিনের সাথে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য একমত। এসব গোত্রের ভিতরে তেমুজিনের স্ত্রী বোরতার গোত্র ওখুনুগাডরাও ছিল।
তেমুজিন যখন তার সৈন্য বাহিনী পুনর্গঠন করছিলেন, তখন হঠাত্ আবিষ্কার করেন যে তঘরুল তার পিছু পিছু এসেছেন এবং তার অবস্থান বেশ কাছেই। এবার তেমুজিন সিদ্ধান্ত নেন যে, পুরোনো বন্ধু তঘরুলকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার এটাই উপযুক্ত সময়। রাতে তিনি দ্রুত তার সেনাদল প্রস্তুত করেন, আকস্মিকভাবে তঘরুলের ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন এবং আক্রমণ করেন। তিন দিন যুদ্ধের পর অবশেষে তঘরুল পরাজিত হন। তঘরুলের কিয়েরিড গোত্রভুক্ত লোকদের মেরে ফেলা হয় এবং যারা বেঁচে যান তাদেরকে তেমুজিনের গোত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তঘরুল নিজে পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেও পরে নাইমান টহল যোদ্ধাদের হাতে মারা যান।
তঘরুলের পরাজয়ের পরে আর মাত্র দুটি পক্ষ অবশিষ্ট ছিল, যারা তেমুজিনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারত—জমুঘার মঙ্গোলীয়রা এবং তাদের মিত্র নাইমান গোত্রের তাইয়াং খান। ১২০৪ সালে তেমুজিন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কেলুরেন উপত্যকা হয়ে নাইমান অধ্যুষিত এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। মাউন্ট খাংখারখান অবধি পৌঁছানো পর্যন্ত চেঙ্গিসের এই যাত্রা অব্যাহত থাকে। খাংখারখানে ইতিমধ্যেই তাইয়াং খান তার সৈন্যদল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন জমুঘা ও তার সৈন্যদলের জন্য। চেঙ্গিস তার নগ্ন তরবারি ও রক্তপিপাসু সেনাপতিদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর। ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর তাইয়াং ও জমুঘা বাধ্য হন পিছু হটে পর্বতের উপরে আশ্রয় নিতে। তাইয়াং ও জমুঘা রাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারলেও তেমুজিনের বিজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারেন না। তাইয়াং খানের নাইমান গোত্র এবং জমুঘার মঙ্গোলীয় গোত্রসমূহ আত্মসমর্পণ করে এবং তেমুজিনের রাজত্বের অন্তর্গত হয়। জমুঘা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু নখদন্তহীন, ক্ষমতাহীন অবস্থায় দস্যুবৃত্তির জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন।
নাইমানদের পরাজয় এবং জমুঘার মঙ্গোলীয় গোত্রসমূহের আত্মসমর্পণের ফলে তেমুজিন মঙ্গোলীয় প্রান্তরের প্রায় সর্বময় ক্ষমতাধর শাসকে পরিণত হন। ছোট আকারের মাত্র দুটি গোত্র তখনো বাকি ছিল তেমুজিনের কাছে পরাজিত হতে। এদের একটি হলো বেশ কয়েকবার পরাজিত হয়ে আবারও পুনর্গঠিত হওয়া মার্কিদ জনগোষ্ঠী এবং মঙ্গোলীয় প্রান্তরের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত ওরিয়াট জনগোষ্ঠী। নাইমানদের পরাজয়ের অল্প কিছুদিন পরেই মারকিদরাও পরাজিত ও বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ওরিয়াট জনগোষ্ঠীও পরাজয় বরণ করে।
দস্যু সর্দারে রূপান্তরিত জমুঘাও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরাজিত হন। তার দস্যুদলের সদস্যরা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তেমুজিন খানের কাছে তাকে ধরিয়ে দেয়। তেমুজিন ও জমুঘা খুবই শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও, তেমুজিন তখনো বিশ্বাস করতেন যে তারা একদিন আন্ডা বা রক্ত শপথের ভাই ছিলেন; আর একজন ভাই সারাজীবনই ভাই। তিনি অনুধাবন করেন যে, ‘যখন দুটি মানুষ আন্ডা বা রক্ত শপথের ভাই হয়ে যায়, তখন তাদের আত্মাও এক ও অভিন্ন হয়ে যায়।’
জমুঘা ও তেমুজিনের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল খুবই মজার। যদিও তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন, কিন্তু কখনোই একে অন্যকে ব্যক্তিগত শত্রু হিসেবে গণ্য করতেন না। তারা পরস্পর যুদ্ধ করেছেন কেবলমাত্র বিজয় এবং জনগোষ্ঠীর উপর নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য। এ অবস্থায় যেহেতু জমুঘা আর তেমুজিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নন, তাকে ক্ষমা করে নিজের দলে নেওয়ার জন্য তেমুজিন প্রস্তাব করেন। কিন্তু জমুঘা সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। বরং তিনি তার নিজের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করেন যা সসম্মানে গৃহীত হয়। সিক্রেট হিস্টোরি অনুসারে, তেমুজিন কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই জমুঘার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন এবং সম্মানের সাথে সমাধিস্থ করেন।
১২০৬ সালের সমাবেশ
১২০৬ সালে সমগ্র মঙ্গোলীয় প্রান্তর বিশাল এক খুরিলতাই বা সমাবেশে সমবেত হয়। এই সমাবেশেই তেমুজিন বিশাল মঙ্গোলীয় প্রান্তরের সম্রাট চেঙ্গিস খানে পরিণত হন। মঙ্গোলিয়ার শাসক হিসেবে চেঙ্গিস খান চেয়েছিলেন তার রাজত্বের দীর্ঘায়ু। যেটা ছিল নানা ধরনের যাযাবর গোত্রের নিয়মিত যুদ্ধক্ষেত্র, সেটাকে দীর্ঘদিন শাসন করা অবশ্যই সহজ কোনো কাজ ছিল না। এ অবস্থাকে স্থিতিশীল করতে, আভ্যন্তরীণ একতা নিশ্চিত করতে চেঙ্গিস খান একটি সিস্টেম চালু করেন। পুরো মঙ্গোলীয় জনগণকে ৯৫টি সেনা ইউনিটে বিভক্ত করে দেন তিনি। এবং যার প্রত্যেক দলকেই ১০০০ সৈন্য নিয়ে দল পরিচালনা করতে হতো। প্রত্যেক দলেই চেঙ্গিস খানের নিজের মনোনীত একজন ব্যক্তি নেতৃত্ব দান করতেন। প্রত্যেক যুদ্ধের আগে প্রত্যেক সেনাপতি ১০০০ সৈন্যসহ অংশ নিতে বাধ্য থাকতেন। আর এটা করতে ব্যর্থ হলে সেই সেনাপতিকে অব্যাহতি দিয়ে সেই দল থেকে নতুন একজন সেনাপতি নির্বাচন করা হতো। যোদ্ধাদের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৫ বছর বয়স হলেই সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে হতো।
সাম্রাজ্যের ভিতরেই চেঙ্গিস বেশ কিছু দপ্তরের প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে রাজ্য প্রশাসন এবং প্রধান বিচারকের কার্যালয় অন্যতম। এছাড়া চেঙ্গিস বেশ কিছু আইন প্রচলন করেন। যেমন :ধর্মীয় সহনশীলতা, ধর্মযাজকদের কর অব্যাহতি, ব্যবহার্য পানি দূষিতকরণে নিষেধাজ্ঞা, ডাকাতি, ব্যাভিচার, সামরিক প্রতারণা, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের অহেতুক হয়রানির মতো অপরাধের শাস্তি স্বরূপ মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি। একদিকে চেঙ্গিস খানকে যেমন একজন প্রতিহিংসাপরায়ণ বর্বর হিসেবে গণ্য করা হয়, অন্যদিকে সন্দেহাতীতভাবেই তাকে একজন অত্যন্ত মেধাবী কূটনীতিক হিসেবেও বিবেচনা করতে হয়।

নতুন সামরিক কাঠামো মঙ্গোলীয় প্রান্তরকে একটি স্থিতিশীল ও যুদ্ধপ্রিয় সমাজে পরিণত করলেও গোটা দুনিয়া জয়ের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। তাই চেঙ্গিস খান বেশ কিছু সামরিক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। এসব উদ্যোগের মধ্যে ১০ থেকে ১০০০ সৈন্য নিয়ে দল গঠন, নিয়মিত সামরিক অনুশীলনের কঠোর নিয়ম এবং সামরিক আইন পালনে কড়াকড়ি ইত্যাদি অন্যতম। এসব নিয়ম ঘোড়সওয়ার এবং ধনুর্বিদ্যায় অভিজ্ঞ এসব মানুষকে একতাবদ্ধ এবং নিয়মানুবর্তী করে তোলে।
তখনো মঙ্গোলীয়রা একটি স্বীকৃত পরাশক্তি হিসেবে পরিগণিত হওয়া থেকে অনেক দূরে ছিল। তাদের দক্ষিণে তখন ছিল পরাক্রমশালী জিন রাজ্য এবং উন্নয়নশীল সঙ রাজ্য। পশ্চিমে রাজত্ব করছিল কারা খিতাই খানরা এবং খরেজমের শাহে্রা। খুব দ্রুতই মঙ্গোলীয় সেনাবাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নিয়মানুবর্তী, অভিজ্ঞ ও ভীতিকর শক্তিতে পরিণত হয়। আর মঙ্গোলীয় প্রান্তরের এই একতাবদ্ধ হওয়া ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা মাত্র।
চেঙ্গিস খান ও মঙ্গোলীয়দের কিছু জানা-অজানা গল্প
১২০১ সালে এক যুদ্ধে চেঙ্গিস খানের ঘাড়ে একটি তীর আঘাত হানে। সে যুদ্ধে পরাজিত এবং আটককৃত সৈন্যদের কাছে নিজের আহত হওয়ার কথা লুকিয়ে তিনি জানতে চান কে তার ঘোড়াকে আহত করেছে। এক সৈন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসে এবং বলে যে, তিনি চেঙ্গিস খানকেই তীরবিদ্ধ করেছেন, তার ঘোড়াকে নয়। সে সৈন্য দয়া ভিক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বলে যে চেঙ্গিস খান চাইলে তাকে হত্যা করতে পারে; কিন্তু যদি তিনি তাকে জীবিত ছেড়ে দেন তাহলে চেঙ্গিস খানকে সর্বোচ্চ আনুগত্য নিয়ে সেবা করবে। চেঙ্গিস তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তার সেনা দলের অন্যতম সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।
একবার চেঙ্গিস খান খরেজমিদ রাজ্যে একদল সওদাগর পাঠালেন, সে রাজ্যের এক শহরের এক শাসক সেই সওদাগরদের হত্যা করে সবকিছু আটক করে নেয়। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ১০০,০০০ সৈন্য নিয়ে সে রাজ্য আক্রমণ করে দখল করে নেন চেঙ্গিস খান। এরপর সেই শাসকের চোখ ও মুখ দিয়ে গলিত রূপা ঢেলে তাকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় চেঙ্গিস এতটাই ক্ষিপ্ত হন যে, খরেজমিদ সম্রাটের জন্মস্থানের উপর দিয়ে কৃত্রিমভাবে একটি নদী প্রবাহিত করে সে স্থানকে মানচিত্র থেকেই মুছে ফেলেন।
চেঙ্গিস খান প্রায় ৪ কোটি মানুষকে হত্যা করেছেন, যা একটি মানুষ সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে গণ্য হয়।
ইয়েলু চুসাই নামক আটককৃত একজন জ্ঞানী চেঙ্গিস খানের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি মঙ্গোলীয় রাজত্বে সবাইকে হত্যা না করে করের আওতায় আনতে চেঙ্গিসকে পরামর্শ দেন।
যেকোনো মিত্র রাজ্যের রাজার সাথে চেঙ্গিস খান তার কোনো এক কন্যার বিয়ে দিতেন। তবে তার আগে সেই রাজার বর্তমান স্ত্রীদের পরিত্যাগ করতে হতো। আর বিয়ের পরে চেঙ্গিস কন্যাকে সে রাজ্য পরিচালনার ভার দেওয়া হতো এবং সেই রাজাকে করা হতো চেঙ্গিসের সৈন্য বাহিনীর একজন সেনাপতি।
মঙ্গোলিয়ার ইখ খোরিগ নামক একটি স্থানকে চেঙ্গিস খান পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা দেন। সে স্থানে কেবল মঙ্গোলীয় রাজপরিবারের সদস্যদেরই প্রবেশের অনুমতি ছিল। এছাড়া সে স্থানের পাহারার কাজে নিয়োজিত একটি সম্ভ্রান্ত যোদ্ধা গোষ্ঠী, দারখাতরাই কেবল সেখানে প্রবেশ করতে পারত। এছাড়া অন্য কারো অনধিকার প্রবেশের শাস্তি ছিল মৃত্যু। দারখাতরা ১৯২৪ সাল পর্যন্ত, অর্থাত্ প্রায় ৬৯৭ বছর এই পবিত্র স্থানের পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছে।
চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যে সমস্ত ধারণা পাওয়া যায়, তার মধ্যে শিকারের সময় ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া কিংবা হাঁটুতে তীরের আঘাত অথবা আটককৃত এক রাজকন্যা কর্তৃক হত্যা সবচেয়ে বেশি সমর্থিত।
চেঙ্গিস খানের সাম্রাজ্যে গরিব ও ধর্মীয় ব্যক্তিরা করের আওতামুক্ত ছিল। তিনি শিক্ষায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, উন্মুক্ত ধর্মচর্চা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব কারণে অনেক রাজ্য জয় করার আগেই সেসব রাজ্য থেকে অনেক লোক তার রাজ্যে এসে যোগদান করেছিল।
সম্রাট শাহ্জাহান ছিলেন চেঙ্গিস খানের সরাসরি বংশধর।
রাশিয়ানদের সাথে যুদ্ধে মঙ্গোলীয়রা বেঁচে যাওয়াদের মাটিতে শুইয়ে তাদের উপর একটি কাঠের দরজা ফেলে তাদেরকে চাপা দিয়ে, তার উপরে বিজয় ভোজ করে বিজয় উদযাপন করেছিল।
চেঙ্গিস খানের এক পুত্রবধূ তোরেজেন খাতুন ৫ বছর মঙ্গোলীয় রাজ্য শাসন করেছিল। এবং তর্কসাপেক্ষে তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে গণ্য করা হয়।
ইরানি মালভূমিতে মঙ্গোলীয়রা এত মানুষকে হত্যা করেছিল যে কিছু কিছু ইতিহাসবিদ ধারণা করেন যে, ইরানের জনসংখ্যা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আগে মঙ্গোলীয়-পূর্ব অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি।
অধিকাংশ যুদ্ধেই মঙ্গোলীয়দের সৈন্য সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু ঘোড়ার উপরে পুতুল বসিয়ে এবং ঘোড়ার লেজে কাঠি বেঁধে কৃত্রিম ধূলিঝড় সৃষ্টির মতো কৌশল অবলম্বন করে তারা বিজয় অর্জন করত।
১২৫৮ সালে মোঙ্গলরা বাগদাদ আক্রমণ করে। সে সময় যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা বলত যে, টাইগ্রিস নদীতে যে পরিমাণ বই নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার কালিতে নদীর পানি কালো হয়ে গিয়েছিল, এবং যত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক হত্যা করা হয়েছিল তাদের রক্তে পানি লাল হয়ে গিয়েছিল। এই সময়কে বলা হয়ে থাকে ইসলামি স্বর্ণযুগের সমাপ্তি।
মঙ্গোলীয়রা তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ধনুকে তীর টানত। তাই বৃদ্ধাঙ্গুলিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলিতে এক ধরনের আংটি পড়ত।
মঙ্গোলীয় যোদ্ধা রাজকন্যা খুতুলুন তার পানিপ্রার্থীদের সাথে লড়াই করে ১০,০০০ ঘোড়া জিতে নিয়েছিলেন।
মঙ্গোলীয়রা কখনো গোসল করত না কিংবা তাদের কাপড় পরিষ্কার করত না। কারণ তারা মনে করত এতে করে পানি দূষিত হয়ে পড়বে এবং যে সমস্ত ড্রাগন পানি নিয়ন্ত্রণ করে তারা রাগান্বিত হবে।
১২৫৪ সালে চেঙ্গিস খান একটি ধর্মীয় বিতর্কের আয়োজন করে। খ্রিস্টান, মুসলমান ও বৌদ্ধদের তিনটি দল এ বিতর্কে বেশ কয়েক রাউন্ড লড়াই করে। কিন্তু এ দলগুলো অতিরিক্ত মাতাল হয়ে পড়ার কারণে কোনো ফলাফল ছাড়াই বিতর্ক শেষ করতে হয়।
মধ্য এশিয়ায় চেঙ্গিস খানের বংশধর সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি। তাই তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সফল বায়োলজিক্যাল ফাদার হিসেবে গণ্য করা হয়।
মঙ্গোলীয় নেতা চেঙ্গিস খান কখনোই কাউকে তার ছবি আঁকার কিংবা ভাষ্কর্য নির্মাণের কিংবা মুদ্রা উপরে তার প্রতিকৃতি খোদাই করার অনুমতি দেননি। তার যেসব ছবি পাওয়া যায় তার সবই তার মৃত্যুর পরে আঁকা।
সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়া মঙ্গোলীয়রা রক্তপাতের বিরোধী ছিল। এর পরিবর্তে তারা এক বিশেষ ধরনের ব্যবস্থায় মানুষকে পিছনের দিকে বেকিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে, কিংবা চোখে এবং কানে গলিত রূপা ঢেলে কিংবা কম্বলে মুড়িয়ে ঘোড়ার গাড়ির নিচে পিষে হত্যা করত।
বিশাল মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যে যোগাযোগের জন্য চেঙ্গিস খান গোটা রাজ্যজুড়ে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। প্রত্যেক ১৫ থেকে ৪০ মাইল পর পর ডাকঘর স্থাপন করে এই ব্যবস্থা চালু রাখা হতো।
১৯৪৫ সালে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ধরা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আর এর ৭০০ বছর আগের মঙ্গোলীয় অভিযান রক্তক্ষয়ের দিক থেকে দ্বিতীয়। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের চেয়ে তখনকার পৃথিবীর লোক সংখ্যা ছিল পাঁচ ভাগের একভাগ। n